html

Friday, November 16, 2018

কবিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

নিষিদ্ধ স্বপ্ন

কবিতা বন্দ্যোপাধ্যায়



হরিধ্বনি আর শ্মশানযাত্রীরা দূরে মিলিয়ে গেলে নীরা যেন সম্বিৎ ফিরে পেল।ধীরে ধীরে অবসন্ন দেহটাকে নিয়ে ঘরের ভিতরে ঢুকলো।চারিদিকে শুধু মা মা গন্ধ, এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে মা শুধু মা।নীরা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখতে লাগলো শুধু, এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে মা আর ফিরবে না।শ্রান্ত হাতে ঘরদোর পরিষ্কার করতে করতে হঠাৎ চোখ গেল ঘড়ির দিকে, আরে আড়াইটে বাজে তো ! কাল তো মা এই সময়েই ফোন করেছিল, এটা সেটা কত কথা বলার পর কুন্দরু -পোস্তর রেসিপিটাও বলেছিল ,মা র গলায় তো কোনো কষ্টের সুর ছিল না....তবে কেন ? 

আজ এখন মা কোথাও নেই নিথর শরীরটা হয়ত এখনো আছে, আর একটু পরে তাও থাকবে না।হঠাৎই নীরার যেন কাঁপুনি হতে লাগল,নীরা তাড়াতাড়ি মার বিছানায় গড়িয়ে পড়ে মার বালিশে মুখ গুঁজে দিলো,মনে হলো যেন মার গলা জড়িয়ে ধরেছে। বালিশে চেনা কেয়োকার্পিনের গন্ধ ।

নীরার মা সুভদ্রা প্রচন্ড সৌখিন সুন্দরী মহিলা ছিলেন,এই বয়সেও তার সৌন্দর্য অনেকটাই অম্লান ছিল ,বরং নীরাই যেন একটু ম্যাড়মেড়ে তার কাছে।মার সেই সুন্দর চেহারাটা এতক্ষণে হয়ত ছাই হয়ে গিয়েছে ; কথাটা মনে হতেই ডুকরে কেঁদে উঠলো নীরা।তার একান্ত আপন (জন্ম সুত্রে পাওয়া)তো শুধু মা আর দাদা ই।বাবা তো সেই কবেই চলে গেছে ,নীরা তখন বছর ছয়েকের ,দাদা দশ ।তারপর থেকেই সুভদ্রার সংঘর্ষ শুরু ,স্কুলের চাকরিটা ভাগ্যিস ছিল তাই বড় হতে সেরকম বাধা পায়নি নীরারা ।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে নীরা এবার উঠলো,কাজে লেগে পড়তে হবে,একা হাতেই করতে হবে সব।সকালে কাজের মেয়েটা এসে সব দেখে হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসেছিল,বারবার জিজ্ঞাসা করছিল"মা-জী কো কেয়া হূয়া থা,অচ্ছী ভালি তো থী কাল "? উত্তর কিছু ছিল না নীরার কাছে ,তাই নীরা ওকে ছুটি দিলো আজকের দিনটা,কাজেই এখন নীরাকেই সারতে হবে সবটা দাদা আর হিমাংশু(স্বামী)ফেরার আগেই।
আজ সকালে নীরা যখন চা বানাচ্ছিল হিমাংশুর জন্য তখনই দাদার ফোনটা আসে,দাদা কোনো রকমে বলেছিল "নীরু মা আর নেই",সেই মুহুর্তে নীরার মনে হচ্ছিল যেন ভূমিকম্প হচ্ছে,হিমাংশু ধরে না ফেললে কি যে হত কে জানে ! নীরাকে তাই একা ছাড়েনি জরুরী মিটিং ক্যানসেল করে নীরার সঙ্গেই এসেছিল সে । মা তখন ঘুমিয়ে ,দাদা মার পায়ের কাছে বসে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ।"কি করে দাদা ...জিজ্ঞাসা করতেই দাদা ইশারায় দেখিয়ে দিল ঘুমের ওষুধের দশটা খালি পাতা।(গত আঠারো বছর ধরে সুভদ্রা ঘুমের ওষুধ খেয়েই ঘুমোতেন এবং এই ওষুধ অনায়াসলভ্য নয় বলে জানাশুনো কেমিস্টের কাছ থেকে নিয়ে স্টক করতেন ,একথা ভাইবোন জানে) ডোর বেলটা বেজে উঠতেই চেতনা ফিরল ওদের ,কয়েকজন প্রতিবেশী এসেছেন ,কজের মেয়েটার কাছ থেকে খবর পেয়েই হয়তো।(আত্মীয়স্বজন বলতে কারোর সঙ্গে সম্পর্ক নেই ,নীরার বাবা মারা যাবার পরে দায়িত্ব নেবার ভয়ে তারা আর সম্পর্ক রাখেনি।)কৌতূহলী প্রতিবেশীদের বোঝানো হল ঘুমের মধ্যেই হার্ট এট্যাক ; ভাগ্যক্রমে হিমাংশু ডাক্তার আর ডোর বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গেই হিমাংশু খালি স্ট্রিপ গুলো ডাস্টবিনে ফেলে দিয়েছিল তাই নীরাদের আর বিশেষ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হল না।

নীরা ভাবলো আগে মার বিছানাটাই ঠিক করবে ,তারপরে ঘর ঝাড়ু পোছা।বিছানাটা ঠিক করতে গিয়ে কানে এল ফোনের মেসেজের আওয়াজ,এদিক ওদিক দেখতে না পেয়ে মার বালিশ টা সরাতেই পেয়ে গেল মার স্মার্ট ফোন টা,শুভ দুপুরের শুভেচ্ছা মেসেঞ্জারে ।নীরা আপন মনেই ফোন টা নাড়াচাড়া করতে করতে দেখ্লো 'তমাল'নামে একজনের সঙ্গে মার রোজই কথা হত ।নীরা কেমন নেশাগ্রস্তের মত স্ক্রল করে পড়তে লাগলো সেই আলাপচারিতা।নীরার মনে হল মার নিঃসঙ্গ জীবনে এক চিলতে সুখ এসেছিল যেন।দুজনেরই পিপি তে নিজেদের ছবি নেই ,সুভদ্রার পিপি একটা ফুল ,নাম কেয়া ...তমালের পিপিতে একটা বাচ্চা ছেলের ছবি ।নীরার মনে হল দুজনেই দুজনকে জীবনে অনেকটা জায়গা দিয়ে ফেলেছে । ঘড়ি টা আবার জানান দিলো যে তিনটে বাজে,নাহ্ আর নয় ,নীরা মার ফোন টা নিজের ব্যাগে ভরে রাখল ,এবার কাজ কর্ম সারতেই হবে।দাদারা ফেরার আগেই সব কাজ সেরে ,স্নান সেরে লোহা,মিষ্টি এগুলোর ব্যাবস্থা করতে হবে ।অতএব ঝাড়ু নিয়ে নীরা লেগে পড়লো।খাটের তলায় কয়েকটা দোমড়ানো কাগজ দেখতে পেয়ে ঝাড়ু দিয়ে সেগুলো টেনে এনে দেখ্লো সেগুলো মার হাতের লেখা এবং আশ্চর্যের ব্যাপার এই যে সেগুলো কাল রাত এগারোটায় লেখা(মা যে কোনো লেখার আগেই সেদিনের তারিখ আর সময় লিখত)। মা লিখেছে "হে ভগবান ,এ আমি কোন পাপের পথে এগোচ্ছিলাম,আমার বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই ,তাই নিজেকে শেষ করে দিচ্ছি "। দ্বিতীয় কাগজটা খুলতেই নীরার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো ।মার ফোনে যেটুকু দেখেছিল তার সঙ্গে একে একে দুই হয়ে গেল। মা লিখেছে "সুভান কে ডেকে সাড়া না পেয়ে ওর মাথার কাছের জানলা টা বন্ধ করতে গিয়ে দেখলাম ,সুভান গাঢ় ঘুমিয়ে ,ওর বুকের উপর রাখা ফোন টায় থেকে থেকে আলো জ্বলছে ,সুইচ অফ করতে গিয়ে দেখলাম কেয়া কে আর তমালকে ,তাদের চ্যাটিং গুলো ও দেখলাম ....এ আমি কি করলাম ? "

নীরার চোখ দিয়ে এবার জল পড়তে লাগল,একটুও রাগ হলো না (মার এই না যেনে করা অপরাধের জন্য )বরং সহানুভূতি তে মন ভরে উঠলো।গত আঠারো বছরের নিঃসঙ্গ জীবনে মা যদি একটু কাল্পনিক সুখের সন্ধান পেয়ে থাকে ,তাহলে ক্ষতি কি ?

না ,নীরা এসব কথা কাউকে জানতে দেবে না ।ব্যাগের থেকে ফোন বের করে চ্যাটিং গুলো ডিলিট করে দিলো ,তারপরে কাগজ গুলো কুঁচি কুঁচি করে ছিঁড়ে দেশলাই জ্বেলে দিলো।জ্বলতে লাগলো মার শেষ লেখা স্বীকারোক্তি,সেদিকে চেয়ে নীরা ভাবতে লাগল ....ওদিকে মা ও হয়তো এতক্ষণে...
নীরা এবার স্নান সারবে,সব শুদ্ধ করে অপেক্ষা করবে দাদা আর হিমাংশুর জন্য।

1 comment:

Facebook Comments