html

Wednesday, November 14, 2018

গৌতম দাস

গৌতম দাস

অপলার ডায়রি 

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৮, বয়স ষোলো

আনন্দ এসে দাঁড়িয়েছি দুয়ারে, চন্ডালিকা তুমি কোথায়?

সবাই বলে ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয়, জানি না, তবে স্বপ্নটা দেখে সকাল সকালই আজ ঘুম  ভেঙ্গে গিয়েছিল, পাতার কুটীরে আমি একা বসে রয়েছি, আঙন জুড়ে খেলে বেড়াচ্ছে মধ্যাহ্নের সূর্য অথচ সেই আলো যেন আমায় স্পর্শ করছে না, আমার দু চোখ জুড়ে শুধুই যেন অন্ধকার,  কোনো  ভাষা নেই সেখানে, স্বপ্ন নেই , বিষাদ নগরে আমি এক বন্দী মানুষী, আর সেই অন্ধকার দূর করে হঠাৎ যেন এসে দাঁড়ালেন এক সন্নাসী , এক হাতে তার দণ্ড , অন্য হাতে  ভিক্ষার ঝুলি , প্রচণ্ড তৃষ্ণার্ত উনি  ,  তবু  ওনার  মুখমন্ডল জুড়ে  কি অদ্ভুত  এক  প্রশান্তি , খোলা  দরজার ওপার থেকে   সেই  দীপ্ত সন্নাসী বলে উঠলেন , আনন্দ এসে  দাঁড়িয়েছি দুয়ারে,   চন্ডালিকা তুমি  কোথায়?

ধুর , সন্নাস্যী  ফন্নাস্যী  কোথায়  , ওটা তো আপনি , আচ্ছা পলাশদা  একটা কথা বলুন  তো, কাল রাতে  আপনাকে  হঠাৎ করে  স্বপ্নে দেখলাম কেন ,  ইনফ্যাক্ট কাল  বিকেলের আগে  আপনাকে  তো  আমি চিনতামই না,  মৃত্তিকা আর কুশল যখন বললো যে  এবারের বসন্ত উৎসবে  চণ্ডালিকা পরিচালনা করবেন আপনি মানে  মৃত্তিকার  দাদার  বন্ধু তখনই তো ওদের কাছে  আপনার  নাম প্রথম শুনলাম  আর  তারপর কাল সন্ধ্যায়  রির্হাসালে দেখা হলো  আমাদের .........   যাই হোক আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, কারন এই  স্বপ্নটার দৌলতে আমি  অনেকদিন  বাদে  আজ আবার একটা ভোর দেখলাম, চারিদিক এখন ভীষণ শান্ত , আমার ঘরের দেওয়াল  ঘড়িটা হাতদুটো জড়ো করে এখন মাটির দিকে মুখ করে  দাঁড়িয়ে রয়েছে  আর আমার  বিছানা- বালিশ ভেসে যাচ্ছে   ভোরের প্রথম আলোয়  , ভোরের   আলো  কি  মিষ্টি  আর নরম , তাই না?  জানেন  আপনার  সঙ্গে  যখন কথা বলছি  তখন  কখন যেন  নাম না জানা একটা পাখী   এসে  বসেছে  আমার  পড়ার  টেবিলে  , পাখীটা  চুপ করে  তাকিয়ে রয়েছে   আমার জিম (জেম) মরিসনের ফটোটার দিকে  ,  প্লিজ ওকে  বলুন না  ও যেন  ওভাবে  না তাকায়  জিমের   দিকে ,  ডাজন্ট শী নো, জিম শুধু  আমারই,   কারোর সঙ্গেই আমি  ওকে  শেয়ার করতে পারি না !

আপনাকে একটা  কথা বলবো পলাশদা  , বিশ্বাস করা বা না  করা  সেটা আপনার ব্যাপার ,  বাট  বিলিভ মি,  প্রতিদিন রাতে না জিম আমার মাথার  কাছে এসে বসে , ওর আঙুলগুলো  তখন খেলে  বেড়ায়  আমার  অবিন্যস্ত  চুল , তারপর  এক সময় আমার  ঘুমন্ত  মুখের  দিকে চেয়ে ও গেয়ে ওঠে

Don’t you love her face?
Don’t you love her as she’s walkin’ out of the door?
Like she did one thousand times before.


       
১০ ই মার্চ, ১৯৭৯, বয়স সতের

তোমার সঙ্গে আজ  যদি   তোমাদের  গ্রামের বাড়িতে  না  যেতাম    তাহলে  হয়তো  জানতেই পারতাম না  আমাদের এই শহরের সীমানা   ছুঁয়ে এত সুন্দর একটা গ্রাম রয়েছে। জানো  পলাশদা , আমি তখন খুব ছোট , আমাদের বাড়িতে পারুলদি বলে এক ভদ্রমহিলা থাকতেন  , ঐ  মানে যাকে  বলে  কি  না  হেল্পিং হ্যান্ড , তা  ঐ   দিদি রোজ  দুপুরবেলায় আমায়  গল্প বলে ঘুম পারাতেন   , এক-একদিন ওনার গল্পে এক দুঃখিনী  মেয়ের  কথা লেখা  থাকতো  , সেই  মেয়েটাও  তোমাদের ঐ  গ্রামটার  মতই  একটা গ্রামে  থাকতো , ঐ যে তোমাদের রেল স্টেশনের  গা  ঘেঁসে  বড়  মাঠটা  বা ধরো  ঐ  মাঠের  বুকে দাঁড়িয়ে থাকা  বিশাল বটগাছটা, আমি কিন্তু পারুলদির  মুখে অনেক আগেই  এদের কথা শুনেছি।

আচ্ছা, পলাশদা  মাসীমাকে কি তুমি  আগেই  আমাদের সম্পর্কের কথাটা বলে  রেখেছিলে, আমার কিন্তু প্রথমদিকে ওনার সঙ্গে কথা বলতে খুব লজ্জা করছিল,  কিন্তু  উনি এত  ভালো  যে আমি সেই লজ্জাটাকে বেশীক্ষণ ধরে রাখতে পারলাম না , তুমি তখন  কোথায় গিয়েছিলে, আমাকে উনি    বললেন , এই মেয়ে, তোমাকে একটা কথা বলবো, আমি কিন্তু ক'দিন ধরেই বুঝতে  পারছিলাম যে আমার বাউন্ডেলে ছেলেটা   কোনো লক্ষ্মীমন্ত মেয়ের শাসনে বাঁধা  পড়েছে  , আর ফেরার  সময় তুমি   তো আগেআগে হাঁটছিলে তাই শুনতে পাওনি , মাসীমা  বললেন  , সুখী হও মা  আর সবাইকে সুখে  রেখো  ,  কথাটা  শুনে জানো তো আমার  ভিতরটা না  তিরতির করে কেঁপে উঠেছিল , পারবো পলাশদা তোমাকে আর মাসীমাকে আজীবন  সুখে রাখতে?

দেখেছ ডায়রি লিখতে গিয়ে আজ  কত রাত  হয়ে গেলো , তুমি এখন কি করছ পলাশদা ,  ঘুমিয়ে  পড়েছ  না কি এখনও বই হাতে  আমার  কথাই  ভাবছ ,  যদি না ঘুমোও তাহলে একবার  হোস্টেলের ঘরের দরজাটার  দিকে  তাকাও  , দেখলে আমাকে? আমি কিন্তু আমার অশরীরী মনটা নিয়ে এখন তোমার  দরজার  ওপারেই দাঁড়িয়ে  রয়েছি  , সারা রাত আজ তোমার   দরজার  ওপাশে  দাঁড়িয়ে  থাকবো আর যখন তুমি  আমায় ডেকে  নেবে   তখন তোমার পাশে  বসে  শব্দ আর অক্ষরের কবিতায়  তোমায়  ভরিয়ে  দেবো, তোমার কপালে আঁকবো  হাজারো  চুমু,  তুমি অবশ্য এসব টেরও  পাবে না, তোমার  ঘুমন্ত  শরীরটা  জানতেও  পারবে  না যে  তাকে  জড়িয়ে আজ সারা রাত  শুয়ে  থাকলো  একটা  নিষ্পাপ  কবিতা 

১০ ই এপ্রিল, ১৯৮১, বয়স ঊনিশ

পলাশদা, তুমি কিন্তু  দিনদিন  ভীষণ  বিচ্ছিরি  হয়ে  যাচ্ছ  , সেদিন  সিনেমাহলে  ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালে, আর আজ? জানো, আজকের দুপুরটার কথা মনে পড়লেই   আমার শরীরটা এখনও  থরথর  করে কাঁপছে, তোমার কবিতার লাইনগুলো খুব মনে পড়ছে, কি সুন্দর তুমি লেখো, উৎসবের  ফুল তোমার পায়ে রেখে     আবার  ভোর হলো   আর আমরা  শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদুরে চলে গিয়ে আবার ফিরে  এলাম  নিজেদের কাছে  , মাঝেমাঝে আমার  কি মনে হয় জানো, তুমি মানুষটা মোটেই  সুবিধের নও , তোমার ঐ  স্বপ্নছায়া  চোখদুটোর  নিচে  লুকিয়ে আছে আসলে একটা  সর্বনাশা  আগুন  যাতে জেনেশুনেও  মন  ঝাঁপ   দিতে  চায়  , এ বাবা!  তোমায়  সর্বনাশা   বলে ফেললাম ! প্লিজ, রাগ  করো না, বিশ্বাস করো  আই রিয়েলি ডিডন্ট মীন ইট,  আর যদি  রাগ  করো তাহলে বয়েই গেছে , আমি  থোড়াই কেয়ার করি  তোমার রাগকে  !

এই পলাশদা, কথা বলছ না কেন, সত্যি সত্যি  রাগ করলে নাকি, প্লিজ কথা বলো , স্পিক টু মি,  জানো, আজ  তুমি কি করেছ আমার , বাড়ি ফিরে দেখি তোমার ঠোঁট আর নখের দাগ আমার সারা শরীর জুড়ে। আমি কিন্তু দাগগুলি  মুছিনি , এখন  সবাই ঘুমিয়ে   পড়ার পর এক-এককরে সেই দাগগুলির ওপর আমার  আঙুল বোলাচ্ছি ,  বিশ্বাস  করো  মনে হচ্ছে আই অ্যাম  টাচিং  ইউ,   তোমার ঠোঁটের উত্তাপ যেন  এখনও  আমার শরীর জুড়ে লেগে রয়েছে  , রাতের ডানায় ভর করে একবার  আসবে  পলাশদা  আরো একবারের জন্য  আমায়  পুড়িয়ে দিতে?

বাই দ্য ওয়ে, আজ সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে কি দেখলাম বলো তো, দেয়র ওয়াজ এ সারপ্রাইজ,   সুমন্তকাকু আর ওনার  স্ত্রী আমাদের  ড্রয়িংরুমে বসে আছেন , ও হরি  তোমায় তো   বলাই হয়নি,  সুমন্তকাকু  হচ্ছেন গিয়ে  বাপীর একদম ছেলেবেলাকার  বন্ধু, এখন ওনারা  বোস্টনে থাকেন, ইন্ডিয়ায়  মাসখানেকের  ছুটি কাটাতে এসেছেন , তবে এবার  রনো আর জুন আসেনি ওনাদের সঙ্গে , জুনের  তো  সামনের মাসে   পরীক্ষা আর রণো  এ বছরই চাকরিতে ঢুকেছে, তাই ছুটি পায়নি।

১০ ই মে, ১৯৮৩, বয়স একুশ

নিজের ঘরের বিছনাটায়  চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলাম  , মৃত্তিকা এসে  বললো   বিউটিসিয়ান মেয়েদুটো এসে গিয়েছে , উঠতে  হবে এবার   , কণে সাজানর ভারটা মা  মৃত্তিকার ওপরই দিয়েছে  আর এই নিয়ে বেচারি এ’কদিন খুব  ব্যস্ত  ছিল। কম করে পনেরটা পার্লার ঘুরে  তবে হাজরা মোড়ের  এই পার্লারটাকে ও ঠিক করেছে, মাকে সেদিন বলছিল, আরে বাবা ছেলে  এন আর আই, যাকে তাকে দিয়ে  কি আমাদের অপুকে সাজানো যায় !

মৃত্তিকার হাত দিয়েই   চিঠিটা  পাঠিয়েছিলাম তোমায় , জানি, চিঠিটা পড়ে তুমি  খুব কষ্ট পেয়েছ, কিন্তু  বিশ্বাস করো পলাশদা  আই ডিডন্ট হ্যভ  এনি আদার  অপশন  ,  অনেক চেষ্টা করেও ম বা  বাপীকে বোঝাতে  পারিনি ,  মা   আমাকে  ইমোশনালি ব্লাকমেল  করছিল ,  কাঁদতে  কাঁদতে  বলছিল  ,  এত কষ্ট করে  তোকে কি  পড়াশুনা  করালাম ঐ  দু টাকার   কবির  হেঁসেল সামলানোর  জন্য , বাপী ওয়াজ ভেরি প্রফেশনাল ইন হিজ অ্যাপ্রোচ। ঠিক যেভাবে নিজের বিজনেস ডিলগুলি নেগোশিয়েট   করে ঠিক সেভাবেই খাতার একদিকে তোমাকে আর অন্যদিকে রণদীপকে ফ্রেম করে আমায় বুঝিয়ে দিয়েছিল যে আজকের একটা ছোট্ট ভুলে  আমার  বাকী  জীবনটা  কেমন ছারখার   হয়ে যেতে পারে । টু বি ভেরি অনেস্ট বাপীর সেই  আর্গুমেন্টের সামনে আমি   নিজেও  তোমার হয়ে  খুব একটা কাউন্টার করতে পারিনি। এন্ড আই  থিংক ইট ওয়াজ নট পসিবল , যেমন ঝুমরি আর বোস্টন কখনো  পাশাপাশি  রাখা  যায়  না  তেমনি তোমার আর রণোর মধ্যে তুলনা করাটাও  ভীষণ  মুশকিল , আই মীন তোমাদের দুজনার  জগৎটাই  আলাদা,  রণো যেমন  কখনো হয়তো তোমার মত ‘অরণ্য পেরিয়ে’ লিখতে  পারবে না তেমনি  তুমি  হয়তো  কখনো রনোর মতো কর্পোরেট  দুনিয়াটাকে ……. যাক গে ছাড়ো এসব কথা , আই নো, বাইরেটা তোমার যতই বাউন্ডেলে হোক না কেন  ভীতরে  ভীতরে  তুমি  একজন ভীষণ  শক্তিশালী পুরুষ  , এই ছোটখাটো আঘাত তুমি ঠিকই সামলে নেবে  আর তাছাড়া  তোমার  প্রথম  প্রেম তো  কবিতা আর  সে তো  তোমার সঙ্গেই থাকলো , পারো  যদি  আমাকে  নিয়ে   লেখা  তোমার  কবিতার  সিরিজটা  শেষ করো , এবার না হয় আমায় চোখের কোনে  লুকিয়ে রাখা  সর্বনাশা আগুনটায় একটা কবিতা জ্বালিয়ে দিও তুমি চিরদিনের  মতো

১০ ই জুন, ১৯৯১, বয়স ঊনত্রিশ

সারাদিন আজকাল এত ব্যস্ত থাকি যে  ডায়রি লেখার  কথা  মাথাতেই  আসে না, সত্যি বলতে কি ডায়রির কথাটা ভুলেই গিয়েছিলাম , আজ আলমারি ঘাটতে গিয়ে পুরনো শাড়ির ভাজ থেকে হঠাৎ করে  আমার সেই কিশোরী বেলার  সঙ্গিনীকে   খুঁজে পেলাম, নিজের অজান্তেই কেমন যেন একটা নস্টালজিয়া ঘিরে ধরলো,  ডায়রির পাতা উলটোতে উলটোতে কত পুরনো কথা মনে পড়ে যাচ্ছে, আর  পুরনো দিন মানেই তো  হাজারো  স্মৃতি নিয়ে  তুমি সেখানে  দাঁড়িয়ে আছ  পলাশদা   ………  কেমন আছ ,  বিয়ে শাদী করেছ নাকি এখনও  ঐ কবিতা , নাটক  এসব নিয়েই মেতে আছ ,  আচ্ছা, তোমার মায়ের কি খবর , উনি কি এখনো  ঐ ঝুমরিতেই  থাকেন নাকি তুমি ওনাকে  কোলকাতাতে  নিয়ে এসেছ? অবশ্য  কোলকাতাটা জাস্ট একটা অনুমান, আমি তো এ-ও জানি না যে  তুমি নিজেই  এখন কোলকাতায় থাকো কি না ?

আমরা এই ক'মাস হলো ইন্ডিয়াতে ফিরে এসেছি, তবে এখন আমরা দিল্লীতে  সেটেল  করেছি , রণো  এখন ওদের কোম্পানির  ইন্ডিয়ান অপারেশনের সি ই ও। দক্ষিণ দিল্লির সাউথএক্সে কোম্পানি আমাদের  থাকার  জন্য  একটা  বিশাল বাংলো দিয়েছে । আমি, রনো আর আমাদের দুই ছেলেমেয়ে আমরা এখন সেখানেই থাকি । জানো পলাশদা  সেদিন তোমাকে  ফিরিয়ে  দেওয়ার  সিদ্ধ্বান্তটা খুব  সহজে নিতে পারিনি আমি ,  নিজের  মনের মধ্যে একটা দ্বন্দ  চলছিল , আয়নায়  বারবার নিজেকে  বিশ্বাসঘাতিনী  বলে মনে হচ্ছিল সেদিন, মৃত্তিকাও বারবার বলছিল তোমাকে এভাবে  আঘাত দেওয়াটা ঠিক নয়,  কিন্তু আজ যখন নিজের দিকে তাকাই , এই বাড়ি , এই  গাড়ি, সুখ , ঐর্শ্বয  তখন মনে হয়    বাপী ওয়াজ রাইট , জীবন শুকনো  কবিতা দিয়ে কখনো সাজানো যায় না , লাইফ ইজ আ পিওর   ম্যাথেমেটিকস এন্ড সেই  অংকে একবার  ভুল  করলে  সারা  জীবন শুধু পস্তাতেই  হয়।

১০ ই জুলাই, ১৯৯৬ , বয়স চৌত্রিশ

বাবাই আর মুনকে নিয়ে গত সপ্তাহেই পুস্পবিহারের এই ফ্লাটটায় উঠে এসেছি। জায়গাটা সাউথএক্স থেকে একটু  দূরে  , বাবাইদের স্কুলটা এখান থেকে বেশ দূরেই হয়ে গেলো  , কিন্তু কি করবো  ,  সাউথএক্সের কাছাকাছি এই রকম একটা ফ্লাটের ভাড়া অনেক বেশী , এই অঞ্চলেও  অবশ্য  বাড়িভাড়াটা কম নয়, তবে  মুনের  বন্ধদের ফ্লাট  বলে  বেশ  সস্তাতে পাওয়া  গেছে এই ফ্লাটটা ,  রণো অবশ্য বারবার  জানতে চাইছিল যে মান্থলি ঠিক  কত টাকা পেলে  আমাদের  সব কিছু ঠিকঠাক  চলে যাবে  , আমি  রাজী হইনি,  রনোর থেকে কেন টাকা নেব,  প্রতি মাসে মাসে  ওর  থেকে  কিছু  টাকা নিয়ে শেষ হয়ে যাওয়া সম্পর্কের প্রেতাত্মাটাকে কেন বয়ে বেড়াব? 

১০ ই আগস্ট, ২০১০, বয়স আটচল্লিশ

বাবাই আজ  ভোর রাতে  জর্জিয়ায় চলে গেলো , মাইক্রো বায়োলজি পড়বে ও ওকাহ্নে , কাল রাতে ব্যাগেজ গোছানোর সময়  ছেলে  বলছিল  , আমার  জন্য  একদম চিন্তা করো না, আই অ্যাম ক্যাপাবেল এনাফ টু টেক কেয়ার অফ মাইসেলফ। ঠিকই বলেছে  বাবাই,  সত্যিই ছেলে আমার  ক্যাপাবেল এনাফ টু টেক কেয়ার  অফ হিমসেলফ , রনোর শরীরের রক্তকণাগুলি  বড় বেশী মাত্রায়  ওর  শরীরে  ঘুরে  বেড়াচ্ছে , শুধু কি রনোর , আমিও  তো  ওর বয়সে  বাপীর  কথায়  কত সহজেই  কনভিন্সড  হয়ে গিয়েছিলাম, নিজেকে বুঝিয়েছিলাম কেরিয়ারের রেসপেক্টে ইমোশনাল হয়ে কিছু   লাভ নেই।  বাবাই   তাই  স্কলারশিপ পাওয়ার পর রনো বা  জুনকে কন্টাক্ট করতে বিন্দুমাত্র  হেজিটেট করেনি।  বাপীকে দিয়ে  ফাইনানসিয়াল ব্যাকআপের অ্যাসিওরেন্স নিয়ে ইমিডিয়েটলি পিসীকে  ফোন করেছিল , আমি  তোমাদের  দেশে  আসছি,  প্লিজ  হেল্প মি  টু  সেটেল দেয়ার  , রণোর সঙ্গে কথা বলবার আগে অবশ্য  একবার আমাকে   জিজ্ঞাসা করেছিল বাবাই,   হোয়েদার আই শ্যল মাইন্ড এনিথিং ,  কিন্তু সেটা তো ছিল  নিতান্তই একটা  জিজ্ঞাসা, অনেকটা যেন বুড়ি ছোঁয়ানো!

তবে মুন অন্য রকম  হয়েছে  , মা হয়েও  আমি যেন  মেয়েকে  ঠিক বুঝতে  পারি না,  যত বড় হচ্ছে তত যেন ও নিজেকে একটা পারসোনালিটির মোড়কে ঢেকে নিচ্ছে। অনেক চেষ্টা করেও আমি সেই  ব্যক্তিত্বের মোড়কটাকে  আনর‍্যাপ করতে পারি  না, লেডী শ্রীরাম কলেজে মুন ইংরেজি নিয়ে পড়ছে, আর  কলেজের বাইরে ওর যে দুনিয়াটা সেখানে শুধুই  বই , জানি না  কোথা থেকে  বইপড়ার  স্বভাবটা পেলো ও , তবে  ওকে যখন  বইয়ের  মধ্যে  ডুবে  থাকতে দেখি  আমার তোমার কথা মনে পড়ে যায় পলাশদা , তুমিও  তো  দিনভর  বইয়ের মধ্যে  নিজেকে  লুকিয়ে  রাখতে।

কিছুদিন আগে  মৃত্তিকা ওর বরকে  নিয়ে দিল্লীতে এসেছিল, ওর কাছেই শুনলাম মাস  দুয়েক আগে এক  পার্টিতে নাকি রণোর সঙ্গে দেখা হয়েছিল ওদের। রনো    রনো ওর অভিনেত্রী বৌ সাহানার সঙ্গে ওদের আলাপও করিয়ে দিয়েছিল । মৃত্তিকাই বললো তোমার নাকি কোলকাতার সাহিত্য মহলে এখন ভীষণ   কদর , তোমার  বইয়ের  সংখ্যাও  নাকি  পঞ্চাশ  ছাড়িয়ে  গিয়েছে। বিশ্বাস করো  পলাশদা , আজ বুঝি,  বাপী ওয়াজ রং , বাপীর  সেদিনের হিসেবটা  একদম ভুল ছিল,  জীবন মানে  শুধু  যোগ-বিয়োগ আর অংক কষা নয়, আসলে  অল্প বয়সে বেশীরভাগ  মেয়ের  মতই  আমিও  একটা  ভুল অহঙ্কার  নিয়ে চলতাম, মনে হতো  জীবনের  সব কিছুই   বড় সহজে বুঝে ফেলেছি, আলো জ্বালালেই তাই  অন্ধকার  দূর   হয়ে গিয়েছে ভাবতাম  , কিন্তু আজ  এই  আহত  সন্ধ্যায় অনুযোগহীন  জানলার  পাশে দাঁড়িয়ে  মনে হয়  জীবনের  দুরুহ   হাতল  যা  যে  কোনো  মুল্যে  ধরে  রাখতে  হয়  আমি  কোনোদিনই তা  ধরে  রাখতে  পারিনি  , এলোমেলো  ভাবে  তাই  হাতের মুঠোয়  থাকা   পাথরের কুচিগুলি  বেহিসেবীর  মত  খরচ  করে ফেলেছি , বিশ্বাস করো পলাশদা  আমার কাছে  আজ  একটাও জোনাকি অবশিষ্ঠ নেই , অন্ধকারটা তাই যেন আমাকে  ক্রমশ  গ্রাস করে নিচ্ছে ,

পারবে  পলাশদা  , আর একবার  আলোর শিখাটা নিয়ে   আমার দুয়ারে এসে দাঁড়াতে , পারবে আরো  একবার  আমার ঘুম ভাঙ্গিয়ে বলে উঠতে  , আনন্দ এসে দাঁড়িয়েছি দুয়ারে, চণ্ডালিকা তুমি কোথায়?

1 comment:

Facebook Comments