html

Friday, November 16, 2018

রমা জোয়ারদার

কোনো একদিন 

রমা জোয়ারদার


দু-হাতে দুটো বাজারের থলি নিয়ে ঘরে ঢুকল দীপঙ্কর । থলিদুটো সোজা রান্নাঘরে নামিয়ে দিয়ে ড্রইং রুমের সোফায় হাত পা ছড়িয়ে বসে পড়ল সে। এমনিতে তো আজকাল দীপঙ্করকে দেখলেই মন্দিরা একেবারে চিড়বিড়িয়ে ওঠে । কিন্তু এখন এই ক্লান্ত , ঘেমো মানুষটার দিকে তাকিয়ে ওর কেমন মায়া হল । মনে মনে বলল – ‘আহা বেচারা ! বয়স তো নেহাত কম হলনা । এই বয়সে শ্বশুর মশাই দায় দায়িত্ব সব ছেলে-বৌদের উপর দিয়ে মনের আনন্দে তাস-দাবা খেলতেন । নাতি-নাতনি নিয়ে আনন্দ করতেন । মাঝে মাঝে অবশ্য টিভি প্রোগ্রাম দেখা নিয়ে ঝগড়াও করতেন । কিন্তু দীপঙ্কর ! বেচারাকে এখনও বাজার-হাট , ট্যাক্স , ইনসিওরেন্স , বাড়ি-গাড়ি , সেই সাথে আবার রোগ-বিরোগ , ডাক্তার-হসপিটাল সব কিছু সামলাতে হচ্ছে । ছেলেপুলেরা জানেও না কি করে কি হচ্ছে ! জানতে চায়ও না তারা । একজন ব‍্যাঙ্গালুরুতে , একজন অস্ট্রেলিয়ায় । অবশ্য ওদের দোষ দিয়ে লাভ নেই । যুগের হাওয়াই এরকম । আর সত্যি বলতে কি ছেলে মেয়েদের এরকম তো ওরাই তৈরি করেছে !’ 

-    ‘একটু জল দেবে ?’ দীপঙ্করের কথায় ভাবনা ছেড়ে এক গেলাস জল স্বামীকে এগিয়ে দিল মন্দিরা । জিজ্ঞাসা করল – ‘কফি খাবে ?’  খবরের কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে ইতিবাচক মাথা নাড়ল দীপঙ্কর । 

রান্নাঘরে ঢুকে গেল মন্দিরা । মেঝেতে নামিয়ে রাখা থলি থেকে মোচা আর সজনে  ডাঁটা উঁকি মারছিল । ওগুলো দেখেই মন্দিরার মন থেকে সব মায়া মমতা উধাও হয়ে গেল । রেগে মেগে চেঁচিয়ে বলল – 

‘আবার এইসব মোচা ঘোচা নিয়ে এসেছ ? দেখছ আজ তিনদিন ধরে রান্নার লোক আসছেনা ! কবে যে আসবে তাও এখন পর্যন্ত জানিনা । কে কাটবে , কে রান্না করবে এখন এসব ? এই বয়সে আমি আর এত পারিনা ! তুমি কি সত্যিই একটুও বোঝনা ? আর বাজারগুলোও হয়েছে তেমন ! আগে দিল্লিতে এসব জিনিস প্রায় পাওয়াই যেতনা । আর এখন , সব জায়গায় সব কিছু পৌঁছে যাচ্ছে । জ্বালাতন একেবারে !’   

গজগজ করতে করতেই মন্দিরা হাতের কাজ সারতে থাকে । এক ফাঁকে কফির জন্য দুধ আর জল গ‍্যাসে বসিয়ে দেয় সে ! দু কাপ কফি বানিয়ে ট্রেতে সাজিয়ে ড্রইংরুমে এসে মন্দিরা দেখল যে দীপঙ্কর ঘরে নেই ! এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখতে না পেয়ে ভাবে - বাথরুমে গেছে বোধহয় ! নিজের মনেই হাসে সে - ঘরেই নেই তাই ! ওই জন্যই এতক্ষণ তার অভিযোগের উত্তরে কোনো গলা পাওয়া যায়নি ! কফির কাপ দুটো সামনে রেখে সোফায় বসল মন্দিরা । টেবিলে পড়ে থাকা টিভি রিমোটটা হাতে তুলে নিল । এ চ‍্যানেল ও চ‍্যানেল করতে করতে কখন যেন একটা প্রোগ্রামের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল । হঠাৎ খেয়াল হল দীপঙ্কর এখনো আসেনি । এতক্ষণ তো বাথরুমে থাকার কথা নয় ! মন্দিরা দুটো বাথরুমই দেখল । না , দীপঙ্কর কোথাও নেই । ফ্ল্যাটটা তো এমন কিছু বিশাল নয় – ঘর বারান্দা সবই দেখল । কেউ কোথাও নেই ! গেল কোথায় ? মন্দিরাকে না বলে তো দীপঙ্কর কখনও বাড়ির বাইরে যায় না ! মানুষটার যত দোষই থাকুক না , এটা মানতেই হবে যে সে কখনও বাড়ির লোককে অযথা দুশ্চিন্তায় ফেলে না । তা হলে হলটা কি ? এই তো এখানে বসেছিল । এর মধ্যেই হাওয়া ? চকিতে একটা কথা মনে হতেই মন্দিরার  শিরদাঁড়ার মধ্য দিয়ে একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল । ক’দিন আগে দুজনের ঝগড়ার সময় দীপঙ্কর বলেছিল – ‘আজকাল কথায় কথায় তুমি এত খ‍্যাচর খ‍্যাচর কর , দেখবে কোনো এক দিন বাড়ি থেকে বেড়িয়ে সোজা যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব !’

মাথাটা যেন কেমন ঝিমঝিম করে উঠল মন্দিরার – সেই কোনো এক দিনটা আজ নয় তো ? আজও তো প্রচুর খ‍্যাচর খ‍্যাচর করছিল সে ! ধুত্তোর , এখন কি হবে ?  

কোথায় যেতে পারে মানুষটা ? এমনিতে অবশ্য বিবাগী হতে গেলে দিল্লী থেকে হরিদ্বার যাওয়ার কথাই আগে মনে পড়ে ! কিন্তু এমন কোন মানে নেই যে হরিদ্বারেই যাবে ! দিল্লী থেকে এলাহাবাদ , রায়পুর , জব্বলপুর , কন্যাকুমারী – সব জায়গাতেই যাওয়া যেতে পারে !  

মন্দিরার মাথার মধ্যে সব গুলিয়ে গেল । ভেবে পেলনা কি করা উচিত এখন ! আশেপাশের চেনাজানা লোকদের খবর দেবে , নাকি তাড়াতাড়ি করে পুলিশকে জানাবে ! এখনো নিশ্চয়ই বেশি দূর যেতে পারেনি ! পুলিশকে জানালে চটপট ধরে আনতে পারবে । ছি ছি ছি , কী কাণ্ড ! এরকম কেউ করে ! সবাই তো এখন মন্দিরাকেই দোষ দেবে । কলকাতায় দেবরকে  কি এখন একটা খবর দেওয়া দরকার ? আর ব‍্যাঙ্গালুরুতে ছেলেকে ? চিরকালের শত্রু মানুষটা ! কারো কাছে মুখ দেখানোর কোনও উপায় রাখলনা !  

কফি কারোরই খাওয়া হয়নি । ঠাণ্ডা হয়ে উপরে স‍র পড়ে গেছে । বাড়িতে তো দুটোই মোটে মানুষ । তাই  চা-কফি খেলে সব সময়ই দুজনে একসাথে বসে খায় ! কফির দিকে তাকিয়ে ভীষণ অনুতাপ হতে  লাগল মন্দিরার । কি দরকার ছিল অত কথা শোনানোর ? না হয় শখ করে একটা মোচা , এক ডজন সজনে ডাটা নিয়ে এসেছিল ! তার জন্য অত কথা না বললেই হত । কান্না পাচ্ছিল মন্দিরার । রাগও হচ্ছিল ! নিজের মনে মনেই বলছিল , এই যে এত তেজ দেখিয়ে বেরিয়ে গেল , কে জানে ব্রেকফাস্টের পর সব ওষুধ গুলো আজ খেয়েছিল কিনা ! 

তবে একটাই শান্তি যে মানি ব‍্যাগটা সঙ্গে আছে ! তার মানে ক্রেডিট কার্ড , ডেবিট কার্ড সবই সঙ্গে আছে । ওষুধ-বিষুধ , খাবার-দাবার যখন যা দরকার কিনে নিতে পারবে । কিন্তু ও তো ওষুধের নামই মনে রাখতে পারেনা । ওষুধ কিনবে কি করে ? ওষুধের লিস্ট তো সবসময় এই ঝগরুটে জঘন্য মহিলা মন্দিরাই বানিয়ে দেয় । ভালো গুণগুলো তো মনে রাখবে না , শুধু খারাপ টাই মনে রাখবে ! বুঝবে , একদিন ঠিক বুঝবে । কিন্তু সেদিন হাজার ডাকলেও আর মন্দিরা ফিরবেনা ।

মন্দিরার বুকের মধ্যে হু হু করে ওঠে । একলা কি করে থাকবে সে ? এই বাড়ি , গাড়ি , বাজার-হাট সবকিছু একলা কি করে ম‍্যানেজ করবে ? আর মোবাইলটা তো যখন তখন গণ্ডগোল করে । কে ঠিক করে দেবে সেটা ?

এই কথাটা মনে হতেই মন্দিরার মাথায় টং করে একটা ঘণ্টি বেজে উঠল । ‘আরে , মোবাইল আছে তো ! মোবাইলে একটা কল করলেই তো হয় ! ফোন যদি নাও ধরে , ওই মোবাইল ট্র্যাক্‌ করে পুলিশ ঠিক ধরে ফেলবে !’

সময় নষ্ট না করে মন্দিরা দীপঙ্করের মোবাইলে কল করল । চারবার রিং হবার পর ওদিক থেকে সাড়া এল – ‘হ্যালো !’ উত্তেজনা চেপে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞাসা করল মন্দিরা – ‘তুমি কোথায় ?’ 

- ‘এই তো সোসাইটির লনে দাঁড়িয়ে কথা বলছি । কেন বলতো ? শরীর খারাপ লাগছে নাকি ?’
- ‘না না ঠিক আছি । আসলে বলে যাওনি তো , তাই ভাবছিলাম – কই গেলে !’ কথা বলতে বলতেই মন্দিরার বুকের ধড়ফড়ানি অনেকটা কমে এল ।

ফোনের ওপাশে একটু হেসে দীপঙ্কর বলল – ‘আসলে বিনোদ ফোন করে বলল , এক মিনিটের জন্য একটু নীচে আসবেন দাদা , একটা কাগজ দেব ।  তাই হুট করে চলে এলাম । তোমাকে বলা হয়নি ।
মন্দিরা চিড়বিড়িয়ে উঠতে যাচ্ছিল – ‘এক মিনিটটা যে এক ঘন্টা হয়ে গেছে , সে খেয়াল আছে ?’ কিন্তু না ! মন্দিরা নিজেকে সামলে নিল । মিষ্টি করে বলল , এখনও কি বিনোদের সাথে কথা বলছ ? 

- ‘না না । বিনোদ অনেকক্ষণ আগে বাড়ি চলে গেছে । এখন আমি , যোগীন্দরজী আর আয়েঙ্গার আড্ডা মারছিলাম ! কিন্তু কি ব্যাপার বলোতো ? তোমার গলাটা এরকম শোনাচ্ছে কেন ?’
- ‘ওমা , আমার আবার কি হবে ? কিচ্ছু হয়নি ! শোনো , তুমি ওনাদের নিয়ে উপরে চলে এসো । কফি খেতে চেয়েছিলে তখন । কফি বানাচ্ছি । গরম গরম কফি খেতে খেতে তিনজনে ঘরে বসে গল্প কর ।
ফোনের ওদিকে বউ-এর মিষ্টি কথায় অনভ্যস্ত দীপঙ্কর কিঞ্চিত ঘাবড়ে গিয়ে বলল – ‘অ্যা-- মানে ---ও--আচ্ছা , আচ্ছা ! আসছি , এখনই আসছি !’ 

মন্দিরা আবার নতুন করে কফি বানালো । ট্রে-তে তিনটে কাপ আর বিস্কুটের প্লেট সাজিয়ে ড্রইংরুমে বসা তিনজনের হাতে যত্ন করে ধূমায়িত কফির কাপ তুলে দিল । সবাই আরাম করে কফিতে চুমুক দিল । তৃপ্তির ছাপ ফুটে উঠল ওদের চোখে মুখে । কিন্তু ঘরে আসার পর আড্ডাটা তেমন আর জমলনা ! 

কথাবার্তায় দীপঙ্করের আর তেমন মন ছিল না । হুঁ হাঁ দিয়েই বেশীর ভাগ বক্তব্য সারছিল । সোফাতে বসেই ও বারে বারে সন্দিগ্ধ চোখে টুকটাক কাজে ব‍্যাস্ত মন্দিরাকে পর্যবেক্ষণ করছিল । অতিথিরা চলে যেতেই ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দীপঙ্কর মন্দিরাকে শুনিয়ে জোরে জোরে বলল – ‘আজকে সূর্য কোন দিকে উঠেছিল ?’  

স্বামীর মুখের মিটিমিটি হাসিটা দেখেই মন্দিরা বুঝতে পারল , সে কি বলতে চাইছে ! রাগটা আবার ফিরে আসছে । কিছু বলবেনা ভেবেও মন্দিরা বলে ফেলল – ‘কেন ?’
–  ‘না,মানে, তোমার মুখে এমন মিষ্টি কথা ! এত আদর আপ্যায়ন – কখনও কপালে জোটেনা কিনা ! তাই জানতে চাইছিলাম !’

আর মাথা ঠাণ্ডা রাখা গেল না ! চিড়বিড়িয়ে উঠল মন্দিরা – ‘তোমার সাথে ভালো ব্যাবহার করা উচিতই নয় । সুন্দর কথা , মিষ্টি কথার কোনো মর্যাদা দাওনা তুমি । অন্তত আমার বেলায় তো কখনোই দাওনা । বুঝবে , যেদিন থাকবনা —!’

মন্দিরার কথার মাঝখানেই বড় একটা শ্বাস ফেলে দীপঙ্কর বলল – ‘যাক বাবা , এতক্ষণে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । কি অস্বস্তি ! এই বয়সে এত মিষ্টি সহ্য হয় না কি ? এখন এই ঝাল ঝাল ব্যাপারটাই বেশ নরমাল লাগছে ! রাগ করতে গিয়েও মন্দিরা দীপঙ্করের হাসি হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেও হেসে ফেলল । মুখোমুখি দাঁড়িয়ে দুজনে হাসতে লাগল । আর হাসতে হাসতেই মন্দিরার চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল !   




No comments:

Post a Comment

Facebook Comments