html

Tuesday, November 13, 2018

শমিত দাশ

কবে আমি বাহির হ'লেম 




ফেব্রুয়ারির শেষ। ব্যাঙ্গালোর থেকে এসে অপেক্ষা বম্বেতে। মাঝরাতের ডেলটা এয়ারলাইন্সের জাম্বো ফ্লাইট। জীবনে প্রথম বিদেশ যাত্রার রোমাঞ্চ। জানলার পাশে নিজের সীটে বসার পরেই জবর চমক। স্যুট টাই পরা এক বিমান-কর্মী সাদরে পাশে বসিয়ে গেলেন এক সুন্দরীকে। মুখটা বড় বেশি চেনা চেনা। কিছুক্ষণ পর  আর থাকতে পারলাম না।
'এক্সকিউজ মি, ইফ আয়্যাম নট রং...আপ...হিরোইন...?



'থি', পাস্ট...'  ঠোঁটের কোনের হাসিটা দিয়েই মনে করিয়ে দিলেন আমাদের ১২ ক্লাসের অন্যতমা প্রিয় নায়িকা। 'আপ..?!' আমার প্রশ্নের উত্তরে বোনাস ফের সেই হাসি। যেন মজা দেখছেন, পাশের সীটে ২৪ বয়সী হতভম্ব আমায়। ঝপাঝপ মনে পড়ে গেল, 'ম্যায়নে প্যার কিয়া' র সব দৃশ্য, গান। কি মজিয়ে দিয়েছিল আমাদের ইয়ুথ প্রবেশ-পর্বে রিলিজ সেই হিন্দী সুপারহিট। ভাবতেই শিহরন। পাশেই কি না 'মেরে রঙ্ মে রাঙনেওয়ালী'! এ কী স্বপ্ন, না কি মায়া! ফ্যালফেলিয়ে ক্যাবলাকান্ত এবার সম্বিৎ ফিরে সচেতন। এগিয়ে দিলাম স্টেপল করা একরাশ টিকিটগুচ্ছ। অটোগ্রাফ? উপরের টিকিটেই সই হল - 'ভাগ্যশ্রী'। শুভ যাত্রার 'ভাগ্য' ভালোই হবে ভাবলাম।  'অওর আপ? সার্ভিস?' কেতা মেরে বল্লাম, 'বিজনেস ট্যুর, টু AT&T' ।





ফ্রাঙ্কফুর্ট অবধি সফরটা বেশ অস্বস্তিতেই কাটালাম বলাই বাহুল্য। স্টাইলিশ নায়িকার পাশে ঠিকমত গুছিয়ে খেতেও পারলাম না। সামান্য খেলাম অতি সঙ্কোচে, মেপে। ওয়াইনও ফিরিয়ে দিলাম।  সামনের স্ক্রীনে ফিল্ম, কানের ফোনের তারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল পাশেই। অথচ নায়িকা নিজে কি রিল্যাক্সড। প্লেনে আর কেউ তো আমার মত আদিখ্যেতায় দেখছে না, বুঝে আরো কুন্ঠিত হয়ে গেলাম। ঘন্টা পাঁচেক পর সাহস করে জিগ্যেস করেই ফেল্লাম - 'হোয়েন এগেন, ইন বলিউড? 'নেভার রিয়েলি!' সংক্ষেপে হেসে উত্তরে আর কিছুই জিগ্যেস করার সাহস হল না। ফ্রাঙ্কফুর্টে নেমে প্লেন বদল। ভাগ্যশ্রী কোথায় হাওয়া হয়ে গেলেন। এখানে ইমিগ্রেশন চেক এ, বেশ ধরে কষে'  মেপেছিল জার্মানেরা। পরে জেনেছিলাম, যে সব তরুণেরা ওদের উপর দিয়ে চাকুরী-কাজে আমেরিকায় লম্বা সফরে যায়, তাঁদের উপর নাকি ক্ষার এদের। অবশ্য ফিরে এসেছিলাম লণ্ডন দিয়ে। মাঝে অনেকটা সময় থাকায়, বেরিয়ে সাধের লণ্ডনের কিছুটা সাইট সিয়িং, মায় লর্ডস আর উইম্বলডন ও ঝাঁকি-দর্শন ভাগ্যে জুটেছিল। সে যাক গে। জীবনে প্রথম ফরেন ট্যুর। তায় আবার ছাপোষা বাঙালির আমেরিকা দর্শন। প্রথম নামলাম  অরল্যান্ডোয়। কোনো ফল মূল/বীজ ইত্যাদি এনেছি কিনা তল্লাশি নিল। হ্যাম্পটন ইন এ যাবার জন্য হাঁদার মত ভাড়া করে বসলাম এক লিম্যুজিন। সটান দুশো ডলার। পরে আহাম্মকিটা বুঝেছিলাম ট্যাক্সি ভাড়া জেনে। কালো ঢাউস গাড়িটায়, চারদিক মোড়া সোফায় এদিক-ওদিকে বসে', সন্ধ্যের আলোয় ফ্লোরিডার রাস্তাঘাট দেখেই চোখ জুড়িয়ে গেল। মনে হল সত্যি যেন স্বর্গে এলাম। তখন মোবাইল ছিল না। মনে হল, বাবা-মা-দিদির কথা, যদি থাকত ওরা সাথে। পরদিন অফিসে এক সহকর্মীর সাহায্যে, মা বাবা কে লেখা বড় একপাতা চিঠি ফ্যাক্স করেছিলাম বাবার অফিসে। তারপরে আরো বেশ কয়েকবার। হোয়াটস্যাপ তো ছিল না। যুক্তরাষ্ট্রে সব কিছুই যেন বিস্ময়। থাকা, খাওয়া, অফিস, যাতায়াত, কি সহজ জীবন। মানুষ কত সহজ।  কোনোকিছু বুঝতে না পারলে, চুপচাপ পাশে এসে হেল্প করে যান সকলে হাসি মুখে। আমেরিকানদের এই স্বভাবটাই সবচেয়ে ভালো লাগল। গেছিলাম একা-ই। ফ্লোরিডায় তিন সপ্তাহের ট্রেনিং শেষ করলাম দু-সপ্তাহেই, ১০০% মার্ক্স আর ট্রেনারের প্রশংসাপত্র পেয়ে।  মাঝের উইক এণ্ডে ভাড়া ট্যাক্সি নিয়ে পুরো ডিজনি ওয়ার্ল্ড, ইউনিভার্সাল স্টুডিও, সি ওয়ার্ল্ড দেখে আনন্দে বিহবল হয়েছি। সবচেয়ে মনে দাগ কেটেছিল সন্ধ্যায় এপকট সেন্টারে আতসবাজির  ইল্যুমিনেশন। মনে হল বিদেশের আকাশে যেন দীপাবলীর আলোর উৎসব দেখলাম।




রবিবার ট্রেনিং ক্লাসের তিন আমেরিকান বন্ধুর সাথে, মিয়ামি সমুদ্রতীর ঘুরে  হোটেলে ফিরেছি। কি আনন্দ কালকে থেকে ক্লাস নেই।  ইচ্ছে মত ঘুরব, ফিরব, মস্তি করব ভাবছি। ডিনারের সময়ে হোটেলে ফোন।  মামা। 'কি রে, কি করছিস? ট্রেনিং কেমন হচ্ছে? ফস করে বলে ফেললাম, শেষ করে ফেলেছি। 'তাহলে, এ সপ্তাহটা ওখানে কি করবি?' আগেই কথা হয়েছিল, কলম্বাস ওহিও তে কাজ তারও পরের সপ্তাহ থেকে। 'এই একটু বেড়াবো ভাবছি।' উত্তরে মৃদু ধমক : ফ্লোরিডায় ভালো যা দেখার তো দেখেই নিয়েছিস। টিকিট কেটে দিচ্ছি। সকালেই চলে আয়। যেমন বলা, তেমনি কাজ। টিকিট চলে এল ফ্যাক্সে হোটেলে। পরদিন ভোরের ফ্লাইটেই Rochester হয়ে, ছোট্ট পাখীর মত ComAir ফ্লাইটে পৌঁছলাম Syracuse. এয়ারপোর্টে হাজির হাসি-মুখে প্রিয় মানি মামী। সাঁ সাঁ ১২০ মাইল (!) স্পীডে গাড়ি চালিয়ে মামীই পৌঁছল বাড়িতে। Radio Physics এর Dean মামা তখন ইউনিভার্সিটিতে। ছোট্ট ভাই স্কুলে। মামী আমাকে ঘরে রেখে, খাবার দাবার বুঝিয়ে চলে গেল নিজের কাজে হসপিটালে। বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা। ঘরে খেয়ে দেয়ে আয়েষ করে বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রকৃতির দৃশ্য দেখলাম। ব্যস লেগে গেল হাঁচি। ভাই ফিরল স্কুল থেকে। তারপরে মামাও। মামী তাড়াতাড়ি ফিরেই বকুনি। লাগালে তো সর্দি! যাই হোক অষুধে তাড়াতাড়ি কাজ হল। ভাইয়ের সাথে খেললাম খুব। অবাক লাগল, অতটুকু ছেলে ভোর ছ'টায় বেরিয়ে যায়, ৩০ মাইল দূরে, প্রাইভেটে বাংলা পড়তে! এঁদের দেখেই শেখার মাতৃভাষার মূল্য। তারপর ফিরে তৈরি হয়ে যায় স্কুলে। কি যে ভালো লাগল। পরদিন দুপুরে এল এক ঢাউস টিভি। স্কুল থেকে ফিরে, পাক্কা বড়দের মত ডেলিভারী নিল অতটুকু, ক্লাস ফোরে পড়া ভাই। বুধবার মামা নিয়ে গেল আমাদের Buffalo তে। নায়াগ্রা ফলস দেখাতে। কানাডার দিক দিয়েও দেখলাম। প্লাস্টিকের এপ্রন পোশাক গায়ে উড়ন্ত বরফ-কুচি আর জলের ছাঁটের মাঝেই হল নায়াগ্রায় রোমাঞ্চকর লঞ্চে ভ্রমণ। ফেরার পথে একটা চকোলেট খেয়ে প্যাকেটটা জানলা খুলে ফেলব ভাবছি।  দেখি ওই ছোট ভাই নিজের চকোলেটের মোড়কটা পকেটে রাখল। জিগ্যেস করতেই বল্ল, ঘরে গিয়ে ওয়েস্টবিনে ফেলব। নিজের বিবেকের থাপ্পড় খেলাম। শিখলাম, যে একটা জাতি, দেশ, এমনিই সভ্য হয় না, উন্নতি করে না। আগে প্রত্যেকে কিছু সৎ দায়িত্ত্ব পালন করতে শিখতে হয়।




দুপুর গুলোয় সবাই কাজে, আমার অখণ্ড অবসর। টিভি দেখতাম, বই পড়তাম, জানলা দিয়ে দৃশ্য উপভোগ। মাঝে মধ্যে ফোনে মামীর ধমক। কি! এখনো খাও নি! এখানে কেউ মুখের সামনে খাবার দেবে না। সব বের করে নিয়ে খেও লক্ষ্মীটি। ওই সময় আমি নিয়মিত কি-বোর্ড বাজাতাম। মামার ঘরে একটা মাঝারি মাপের অর্গ্যান ছিল। পরদিন বিকেলে বসে বাজাচ্ছি আর গলা খুলে গাইছি - শ্যামল মিত্রের গান হিমাংশু দত্তর সুরে - 'তোমারি পথপানে চাহি'।  কাজ থেকে ফিরে গ্যারেজ থেকে সে শুনেই মামী কি খুশি। চলো কালকে আমাদের পটলাক পার্টিতে! ব্যাপারটার মানে তখনো জানতাম না। পরদিন শনিবার সন্ধ্যেয় মামা-মামী-ভাইয়ের সাথে সেজেগুজে গেলাম সেই প্রবাসী বাঙালিদের খান-পান আড্ডায়। কি নেই সেখানে? সরশে ইলিশ থেকে পাতুরি, ছেঁছকি থেকে হেঁচকি.. কিছুই বাদ নেই। দিব্যি চুপচাপ সব কিছু চেখে দেখছিলাম, বেশ সাঁটাচ্ছিলাম। হঠাৎ মামার ঘোষণা - এবার 'ইয়ং বেঙ্গল' আমাদের গান শোনাবে। ব্যাস, সব ওমনি চারপাশে গোল হয়ে ঘিরে বসল। গাও, গাও, গাও। এতক্ষণ খেতে খেতে মামা-মামীর সিনিয়র বন্ধুদের টিন এজার সুন্দরী মেয়েদের আড়চোখে দেখছিলাম। এবার দেখি তারাও ড্যাবডেবিয়ে তাকিয়ে। লে হালুয়া! কি গেরো! এই অত্যাধুনিকাদের সামনে আমি কি গান গাই? আস্তে আস্তে সুর ধরলাম- 'লাল নীল হলুদের মেলা বসেছে'। নাহ, দেখলাম ফিট করে গেছে। ওরাও দিব্যি কাঁধ ঝাঁকিয়ে এনজয় করছে, বিস্ময়ে তাকিয়ে, ভাবছে হয়ত ওদের ক্লিফ রিচার্ডের 'সামার হলিডে' র থিমের এই বাংলা গান ব্যাটা কোত্থেকে শিখল! উতরে গেলাম। শেষ হতে না হতেই 'আরেকটা৷ আরেকটা।' এরপর 'জীবনে কি পা'ব না', 'আমি আগন্তুক', 'যাক ধুয়ে যাক', থেকে 'তোমাকে চাই', সুধীন-সলিল-সুমনের গান পরপর। মাঝে মাঝে অল্প শ্যাম্পেনে চুমুক, ব্যাস মুডে এসে গেলাম। এরপর সুন্দরী বৌদিদের, দাদা দের আঙ্কল আন্টিদের পছন্দের গানের অনুরোধের আসর। রবীন্দ্রনাথের গান শুনে, এক বিদেশিনী বৌদির অনুরোধে সংস্কৃত ব্রহ্মসঙ্গীতও মানে-সহ শোনাতে হল। দেখলাম, মামীকে ঘিরে কিছু ফিসফাস। পরে রাত দুটোয় গাড়িতে উঠে মামী বল্ল, ওহে হিরো, সবাই তোমার ইণ্ডিয়ার নম্বর, খবর চাইছে। করেছো কি! পরদিনই দে ছুট। বিকেলের ফ্লাইটেই গেলাম কলম্বাস। সেখানে আরো কত কান্ড। সব বলব। আপাততঃ আজ এই অবধি ✒'কলম, ব্যাস'!  (চলবে)

2 comments:

  1. খুব ভালো লিখেছেন।দারুণ।

    ReplyDelete
  2. অনেক ধন্যবাদ

    ReplyDelete

Facebook Comments