html

Saturday, November 10, 2018

প্রিয়দর্শী দত্ত

স্বদেশচিন্তায় রবীন্দ্রনাথ

প্রিয়দর্শী দত্ত



ঠিক যে বছর রবীন্দ্রনাথের জন্ম হয় অর্থাত ১৮৬১ ক্রিস্টাব্দে ভারতীয়রা প্রথম আইন সভা বা লেজিসলেটিভ কাউন্সিলগুলি তে প্রবেশ করার অধিকার পায়| তাঁর ঠাকুরদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৭৯৪-১৮৪৬) তো চাইতেন খোদ ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টে ভারতীয়দের প্রতিনিধিত্ব হউক| কিন্তু এ বিষয় উইলিয়াম গ্ল্যাডস্টোনের সঙ্গে তার আলোচনা নিষ্ফল হয়| পিতা দ্বারকানাথ ঠাকুর (১৮১৮-১৯০৫)ছিলেন সম্পুর্ন ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ | যৌবনের উন্মেষই উপনিষদের দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তৈরী করেন তত্ত্ববোধিনী সভা| পরবর্তী কালে সভা মৃতপ্রায় ব্রাহ্মসমাজে বিলীন হয়ে তাকে সঞ্জীবিত করে। রবীন্দ্রনাথের উপর তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রভাব ছিল যেমন ভারতীয় সংস্কৃতির উপর হিমালয়ের|  কেবল একবারই ২৯ জুলাই, ১৮৫৩ ক্রিস্টাব্দে কলকাতার টাউন হলের জন সভায়ে তাকে ভারতে রাজনৈতিক সংস্কারের কথা বলতে শোনা গিয়েছিল|

উনিশ শতকের বাংলায়ে যে রাজনৈতিক সচেতনাতার আবহ দেখা গিয়েছিল কি এক কারণে বাংলার তিন মনীষী বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ ও স্বামী বিবেকানন্দ তার থেকে দুরে থাকেন| কিন্তু এই ত্রয়ীকে না পড়লে ভারতবর্ষের মূল স্বরূপ ই অধরা থেকে যায়| বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাস চেতনার স্রষ্টা, ও দেশ কে প্রথম দেশমাতৃকা রূপে প্রতিষ্ঠিত করেন| স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুজাতির গৌরববোধ জাগিয়ে ছিলেন ও ভারতবর্ষ কে রাজনৈতিক নয় আধ্যাত্মিক দৃষ্টি দিয়ে দেখেছিলেন| রবীন্দ্রনাথের কাছে স্বদেশ ভারতের চিরন্তন ভাবনা, জীবন মূল্য আর জীবন শৈলীর মুর্ত্য রূপ| এই ত্রিমূর্তি প্রতক্ষ্য ভাবে ভারতের স্বাধীনতার কথা বললেনি| বঙ্কিম চন্দ্র ও বিবেকানন্দের যুগে সে দাবি ওঠেই নি| কিন্তু রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ জীবনকালে সে দাবি পরিনত| অরবিন্দ, গান্ধী, নেহেরু, সুভাষচন্দ্র অনেকের সাথেই তার সুসম্পর্ক ছিল| কিন্তু রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন মুক্তির গান, দিয়েছিলেন আপনার সাধনা দ্বারা দেশ কে স্বদেশ করে তোলার বার্তা| যে সময় ভারতের জাতীয় আন্দোলন নদী আপন বেগে পাগল পারা সেই সময় রবীন্দ্রনাথ যেন স্বব্ধ চাঁপার তরু গন্ধে ভরা|‘আমি সদা অচল থাকি, গভীর চলা গোপন রাখি’ অথবা ‘আমার চলা যায়না বলা- আলোর পানে প্রানের চলা’|

রবীন্দ্রনাথের সার্বজনিক জীবন শুরু হয়েছিল এক জাতীয়তাবাদী মঞ্চে- হিন্দু মেলা| এই বাত্সরিক মেলার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ব্যায়ামবীর নবগোপাল মিত্র ও পৃষ্ঠপোষক ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরপরিবার| মেলা আয়োজিত হয়েছিল পর পর নয় বছর – ১৮৬৭ থেকে ১৮৭৬| এখানেই ১৮৭৫ ক্রিস্টাব্দে ১৪ বত্সরের কিশোর   রবীন্দ্রনাথ জনসমক্ষে তাঁর প্রথম কবিতা পাঠ করেন – হিন্দু মেলার উপহার| কয়েকদিন পরেই এই কবিতাটি অমৃতবাজার পাত্রিকায়ে প্রকাশিত হয়|

হিন্দু মেলার মাধ্যমেই বাংলায়ে দেশাত্মবোধক গানের সূত্রপাত হয়| রবীন্দ্রনাথের বড়দা ও ভারতের প্রথম ICS অফিসার সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন –“মিলে সব ভারত সন্তান/এক তান মন প্রাণ/ গাও ভারতের যশোগান” ইত্যাদি| হিন্দু মেলা দীর্ঘজীবি হয় নি কিন্তু পরবর্তী কালে বাংলায় জাতীয়বাদী আন্দোলনের মানস ভিত্তিভূমি রচনা করে|

উনিশ শতকের শেষ প্রান্তে রবীন্দ্রনাথ মধ্য যৌবনে| এক দিকে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান, ইতিহাস চর্চা, বঙ্কিমের সাহিত্য, অন্যদিকে স্বামী বিবেকানন্দের বিশ্বমঞ্চে উদয়, তার সিংহল বক্তৃতা ভারতে হিন্দু গৌরবের ঘোষনা করছে| কবি এই দশকে লেখেন ‘কথা ও কাহিনী’| গৌতম বুদ্ধ, শিবাজি, তাঁর গুরু সমর্থ রামদাস, শিখ গুরু গোবিন্দ সিংহ, তরু সিংহ, বন্দা বাহাদুর ইত্যাদি অনেকের বৃতান্ত এতে স্থান পেয়েছে| অনেকে রবীন্দ্রনাথ যে হিন্দু জাতীয়তাবাদের সমর্থক ছিলেন তা প্রমান করতে এই সব কবিতার উদ্ধৃতি দেন| অন্যরা তাঁকে বিশ্বমানব, মহামিলনের প্রতীক ইত্যাদি বলেন| সম্যক ভাবে রবীন্দ্রনাথের চিন্তার গভীরতা মাপতে আমরা এখনো অসমর্থ|

রবীন্দ্রনাথের মধ্যে যে ভারতবোধ মজ্জাগত ছিল তা ইতিহাস বা রাজনীতি নয় কৃষ্টি| তাতে ছাতিমের শীতল গন্ধের মত উপনিষদ, রামায়ন, মহাভারত ও কালিদাসের কাব্যের নির্যাস ছিল| ইতিহাসের ঘটনাবহুলতা রাজনীতির কচকচানির মত তাকে তাকে ক্লান্ত করত| কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ভারতের তত্কালীন রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে ব্যথিত ছিলেন| তাঁর কাছে বিদেশী শাসন ভারতের জাতীয় জীবন পদ্ধতি ও মূল্যের উপর আঘাত ছিল|



অনেকের ধারণা যে রবীন্দ্রনাথ ভারতে ইংরাজ শাসনের কুফল সম্বন্ধে ওয়াকিবাল ছিলেন না| অথবা তার বিশ্বমানবতা তাকে জাতীয়তাবাদের পথ থেকে দুরে সরিয়ে রাখে| কেবল বঙ্গভঙ্গে যুগেই তিনি শুধু স্বদেশিকতার দিকে ঝুঁকেছিলেন| তা কিন্তু একেবারেই নয়| বঙ্গ ভঙ্গের অনেক আগে, ১৮৯৩ ক্রিস্টাব্দে তার লেখা প্রবন্ধ, ‘ইংরাজ ও ভারতবাসী’ তে তিনি বলছেন-

“ইংরেজও আপনার চরিত্রের মধ্যে ঔধ্যতকে যেন কিছু বিশেষ গৌরবের সহিত পালন করে| তাহার দ্বৈপায়ন সংকীর্ণতার মধ্যে সে যে অটল এবং ভ্রমণ অথবা রাজত্ব উপলক্ষ্যে সে যাহাদের সংস্রবে আসে তাহাদের সহিত মেলামেশা করিবার সে কিছুমাত্র প্রয়াস পায় না,....তাহার ভাবখানা এই যে, ঢেঁকি যেমন স্বর্গেও ঢেঁকি তেমনি ইংরাজ সর্বত্রই খাড়া ইংরাজ, কিছুতেই তাহার অন্যথা হইবার জো নাই”

সে যুগে ভারতীয়রা ইংরেজদের থেকে নাগপাশ থেকে উদ্ধার পাওয়ার কোনো পথ ই দেখতে পাচ্ছিল না| রবীন্দ্রনাথ শেষ অংশে এক যুগপুরুষের অপেক্ষায় আছেন যাকে তিনি গুরুদেব বলে সম্বোধন করছেন|

“আমাদের সেই গুরুদেব আজিকার দিনের ই উদ্ভ্রান্ত কোলাহলের মধ্যে নাই; তিনি মান চাহিতেছেন না, পদ চাহিতেছেন না, ইংরেজি কাগজের রিপোর্ট চাহিতেছেন না, তিনি সমস্ত মত্ততা হইতে মুঢ জনস্রোতের আবর্ত হইতে আপনাকে সযত্নে রক্ষা করিতেছেন; কোন একটি বিশেষ আইন সংশোধন বা বিশেষ সভায় স্থান পাইয়া আমাদের দেশের কোনো যথার্থ দুর্গতি দূর হইবে আশা করিতেছেন না”

কে এই গুরুদেব? তিনিই কি পরবর্তী কালের সেই রবীন্দ্রনাথ যিনি কল্লোলিনী কলকাতা ছেড়ে বীরভূমের উষর প্রান্তরে শান্তিনিকেতনে ভারতের উন্নতিকল্পে তপস্যায়ে নিমগ্ন হন| তাঁর পথ ভারতের স্বাধীনতার পথ নয়, ভারতের মুক্তির পথ|

বঙ্গ ভঙ্গের ঘোরতর দিনে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়জীবনের সম্মুখার্ধে উঠে এসেছিলেন| সে সময় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির ভেতরে গোপন বৈঠক হত| পুলিশ সব জানত, কিন্তু বিশেষ ঘাঁটাত না| অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর স্মৃতিচারনা ‘ঘরোয়া’ গ্রন্থে সে সব দিনের বর্ণনা দিয়েছেন|

জাতীয়তাবাদীদের একটি লক্ষণ হলো তারা দেশের দুঃখ দুর্দশার দোষ শাসকের ঘাড়ে চাপিয়েছি খান্ত| রবীন্দ্রনাথ এই দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালোচক ছিলেন| তিনি ২২ জুলাই, ১৯০৫ কলকাতার মিনার্ভা প্রেক্ষাগৃহে ‘স্বদেশী সমাজ’ নামক একটি ধীর্ঘ প্রবন্ধটি পাঠ করেন| জনতার দাবিতে প্রবন্ধটি তার অসুস্থতা সত্বেও অন্য একদিন দ্বিতীয়বার পাঠ করতে হয়| রবীন্দ্রনাথের ভাষায় স্বদেশী সমাজ এর মর্মকথা এই রূপ- “সরকার বাহাদুর-নামক একটা অমানবিক প্রভাব ছাড়া আমাদের অভাব-নিবারণের আর কোনো উপায় আমাদের হাতে নেই, এই ধারণা মনে বদ্ধমূল হতে দেওয়াতেই, আমরা নিজের দেশকে নিজে যথার্থভাবে হারাই| আমাদের নিজের দেশ যে আমাদের নিজের হয় নি তার প্রধান কারণ এ নয় যে, এ দেশ বিদেশীর শাসনাধীনে| আসল কথাটা এই যে, যে দেশে দৈবক্রমে জন্মেছি মাত্র সেই দেশে সেবার দ্বারা, ত্যাগের দ্বারা, তপস্যা দ্বারা, জানার দ্বারা, বোঝার দ্বারা সম্পুর্ন আত্মীয় করে তুলি নি- একে অধিকার করতে পারি নি| নিজের বুদ্ধি দিয়ে, প্রাণ দিয়ে, প্রেম দিয়ে যাকে গড়ে তুলি তাকেই অধিকার করি”|

এর নাম ই রবীন্দ্রনাথ দিয়েছিলেন আত্মশক্তি| ভারত বর্ষের ইতিহাস কে রবীন্দ্রনাথ শুধু ক্ষমতার জন্য মারামারি কাটাকাটির ইতিহাস হিসেবে দেখতে অস্বীকার করেছেন| বিদেশীরাই ভারতের ইতিহাসের মুখ্য উপাদান নয়| দিল্লি আগ্রা যখন ছিল, তখন কাশী ও নবদ্বীপ ই ছিল| ‘আমরা ভারতের আগাছা-পরগাছা নহি, বহু শতশতাব্দীর মধ্য দিয়া আমাদের শতসহস্র শিকড় ভারতবর্ষের মর্মস্থান অধিকার করিয়া আছে| কিন্তু দূরদৃষ্ট-ক্রমে এমন ইতিহাস আমাদিগকে পড়িতে হয় যে, ঠিক সেই কথাটাই আমাদের ছেলেরা ভুলিয়া যায়| মনে হয় ভারতবর্ষের মধ্যে আমরা যেন কেহই না, আগুন্তুক বর্গই সব| নিজের দেশের সঙ্গে নিজের সম্বন্ধ এই রূপ অকিঞ্চিত্কর বলিয়া জানিলে, কথা হইতে আমরা প্রান আকর্ষণ করিব’ |

রবীন্দ্রনাথের গান ও কবিতা আমাদের ভালো লাগে কারণ তিনি আমাদের হৃদয়ে প্রবেশ করবার পদ্ধতি জানতেন| যা কিছু ভেবেছি, অনুভব করেছি, অথচ প্রকাশ করতে পারিনি রবীন্দ্রনাথ আমাদের জন্য তা করে দিয়ে গেছেন| ‘ভাষাহারা মম বিজন রোদনা/প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা/চিরজীবনের বাণীর বেদনা’ রবীন্দ্রনাথে ব্যক্ত| একই ভাবে রবীন্দ্রনাথ দেশের হৃদয়ে প্রবেশ করার পদ্ধতি জানতেন| আশা করি আমরা তাঁর সেই পক্ষের ও অনুশীলন করবো

No comments:

Post a Comment

Facebook Comments