html

Monday, October 22, 2018

মণিরত্ন মুখোপাধ্যায়

মণিরত্ন মুখোপাধ্যায়

লেজ সংক্রান্ত মিনির প্রশ্নাবলী



রবীন্দ্রনাথের মিনি পৃথিবীবিখ্যাত। আমাদের মিনি অতটা না হলেও তেমনটা হবার যোগ্যতা রাখে। আমার মনে হয় পৃথিবীর তাবৎ মিনিরাই অসীম যোগ্যতা সম্পন্ন। আমরাই তাদের চিনতে পারিনা। আমাদের মিনি আমার ছোটমাসীর ছোটমেয়ে। বয়েস চার, ফর্সা, টুবো টুবো গাল, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া চুল, এবং আমার পরম ভক্ত। তার কারণ আমিই এই পৃথিবীতে তার অপূর্ব প্রশ্নবানের একমাত্র শ্রোতা এবং আলোচনার উপযুক্ত মানুষ। আমাদের বাড়িতে এসেই সে জুতো না খুলে সোজা আমার ঘরে এসে হাজির হয়, এবং আলোচনার সূত্রপাত করে। সে আলোচনার কোনও মাথামুণ্ডু থাকেনা। যেমন একদিন এমনি ভাবে শুরু করল।
-- টিকটিকির লেজ আছে, আমার নেই কেন বাবুদাদা? 
দেখলাম তার চোখ আটকে আছে দেওয়ালে, সেখানে এক পুরুষ্টু টিকটিকি ইতিউতি তাকাচ্ছে, বোধহয় মিনি উদয় হবার পর এখন তার কী করণীয় ভাবছে। কেননা কোনও পোকা বা মশা মাছির বের হবার সময় হয়নি এখনও। এখন বিকেলবেলা, আমি সবে কলেজ থেকে ফিরেছি। চা জলখাবার খেয়েছি। অতএব আমার হাতে এখন সময় আছে মিনির অবান্তর অসম্ভব এবং অত্যন্ত কঠিন প্রশ্নাবলীর জবাব দেবার। আমি বললাম
-- আছে, তোমারও আছে লেজ, তবে খুব ছোট, প্রায় দেখা যায়না। টিকটিকির মত বড় লেজ মানুষের হয়না, হনুমানের হয়।
এই যে ধরিয়ে দেবার চেষ্টা, এই যে টিকটিকি থেকে হনুমানের দিকে ঘুরিয়ে দেবার প্রচেষ্টা, এটা একমাত্র আমিই পারি। এখন প্রশ্ন আসবে হনুমানের দিক থেকে, টিকটিকি থেকে সরে যাবে তার ভাবনা চিন্তা। হয়ত জিজ্ঞাসা করবে হনুমানের মুখটা কালো হয়, আমার মুখটা কালো নয় কেন? কিন্তু তা হলনা, তার বদলে সে নিজের ইজেরের দড়িটা খুলে তার ফর্সা গোলগাল পেছনটা আমাকে দেখিয়ে বলল
-- কোথায় আছে আমার ছোট্টমত লেজ দেখাও?
আমিও তেমনি, তার পিঠ থেকে আমার তর্জনীটা সোজা নামিয়ে নিয়ে এলাম একেবারে পুচ্ছদেশের বাঁকে। বললাম
-- এইখানে ঢুকে আছে তোমার লেজ। বাইরে থেকে দেখতে পাবেনা। 
খুশি হয়ে ইজেরটা পরে নিল সে। ছোট হলেও, দেখা না গেলেও, তারও যে লেজ আছে এটা তার পক্ষে পরম সুখের খবর। এবার আমি তাকে আমার বায়োলজির বইটাতে মানুষের শিড়দাঁড়ার ছবি দেখিয়ে বললাম
-- এই শেষের দিকের ছোট ছোট চারটে হাড়, এগুলো তোমার লেজের। তবে এগুলো এত ছোট যে বাইরে থেকে দেখা যায়না।
-- কেন দেখা যায়না? 
নাও ঠেলা, কেন দেখা যাবেনা সেটা কেমন করে বোঝাই। আমি আবার তার প্রশ্নবান ঘোরাবার চেষ্টা করলাম। বললাম
-- বাঘের লেজ বড়, কুকুরের লেজ ছোট, বেড়ালের লেজ আরও ছোট, টিকটিকির লেজ তার থেকেও ছোট, ছাগলের লেজ খুব ছোট, আর মানুষের লেজ সবচেয়ে ছোট বলে দেখা যায়না। আছে তবে দেখা যায়না। 
এখানে আমার মনে পড়ল এমন কত মানুষকে আমি চিনি যাঁদের সত্যি লেজ দেখা যায়। মানে চোখে দেখা না গেলেও কাজে দেখা যায়। আরও একটা কথা আছে। মানুষের লেজ দেখা যাবে কেমন করে? তারা তো আর উলঙ্গ থাকেনা, তারা আবার ধুতি শাড়ি কিংবা জিনস টপ পরে থাকে। অতি ছোট প্রায় অদৃশ্য লেজ থাকলেও সেটা দেখবার জন্যে উচ্ছাস প্রকাশ করা অসভ্যতার নামান্তর। তেমন তেমন হলে মারধোর খাবার ভয়ও থেকে যায়। আমি জানি বাঘ, কুকুর, বেড়াল, ছাগল বা মানুষ সকলেই স্তন্যপায়ী জীব, এবং তার সঙ্গে রেপটাইল জাতের টিকটিকির তুলনা করা মোটেই উচিত কাজ হয়নি। কিন্তু মিনি সেদিক দিয়েই গেল না। বলল
-- বাবুদাদা, তুমি দেখেছো বড় বড় বাঁদরের বড় বড় লেজ হয়, আর ছোট ছোট বাঁদরের ছোট ছোট লেজ হয়। 
-- দেখেছি। 
-- ছোট ছোট বাঁদরের বাচ্চারা নিজের লেজ নিয়ে খেলা করে দেখেছ? নিজের লেজটা ধরতে যায়, কিন্তু ধরতে পারেনা। সেটাকে ধরবার চেষ্টা করতে গিয়ে কেবলই ঘুরপাক খায়। 
চারবছরের মিনির মুখে এতবড় দার্শনিক তত্ব শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। ছোট ছোট বাঁদররাই নয়, ছোট ছোট মানুষরাও নিজের লেজ ধরবার প্রাণান্ত প্রয়াসে ঘুরে ঘুরে মরে। তবু সেটাই করতে চায়। তাদেরও ছোট মত লেজ গজিয়েছে বলে মনে করে থাকে। সেখানে বাঁদরের বাচ্চার সঙ্গে মানুষের বাচ্চার তফাত অতি সামান্য। মিনি এবার বলল
-- আমি টিভিতে দেখেছি বিশাল বিশাল জন্তুদের বিশাল বিশাল লেজ হয়। ডাইনোসর দেখেছি, উরি-ব্বাপস্‌, এত্ত বড় লেজ। কুমিরদের মস্ত বড় লেজ হয়। কিন্তু হাতিদের লেজ ছোট্ট মত। কেন বাবুদা?
-- হাতিদের বুদ্ধি কম। বিরাট শরীর হলে কী হবে হাতিদের বুদ্ধি নেই একদম। 
-- আর সবচেয়ে বড় লেজ কাদের? 
-- এরোপ্লেনের। এরোপ্লেনের সবচেয়ে বেশি বুদ্ধি তাই ওদের লেজ সবচেয়ে বড়, সাবচেয়ে উঁচু। 
-- ঠিক বলেছ, একসঙ্গে অতগুলো মানুষকে নিয়ে উড়ে যাচ্ছে, বল? কেমন উড়ছে, আবার নেমে পড়ছে নিজে নিজে। 
নিচ থেকে ডাক পড়ল – মিনি, চলে এস। তোমার খাবার তৈরি। 
মিনি যেতে যেতে বলল – পরের দিন যখন আসব তখন আবার লেজ নিয়ে তোমার সঙ্গে আলোচনা করব। 
আলোচনা কথাটা নিশ্চয় সে তার বাবার কাছ থেকে শিখেছে। ঠিক সময়ে লাগিয়ে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু আমি তখন চিন্তা করছি এরোপ্লেনের লেজের সঙ্গে ডাইনোসরের লেজের তুলনা করা কী ঠিক হল? একজন জীবন্ত প্রাণী আর একজন যন্ত্রপাতি দিয়ে তৈরি মেশিন। তবে একটা যেন কোন ইংরিজি ছবিতে উড়ন্ত ডাইনোসর লেজ দিয়ে প্লেনকে আছড়ে ফেলল দেখেছি, মনেহয় টিভি তে। সেখানে ওদেরও মিনির মত কল্পণার দৌড় দেখে তাজ্জব হতে হয়। ডাইনোসরের কালে এরোপ্লেন কোথায় ছিল বলুন দেখি? 

  -----------------------------

No comments:

Post a Comment

Facebook Comments